শুনতে হয় কতশত কটু কথা, পড়তে হয় বিব্রতকর
অবস্থায়। এ তো গেল সাধারণ পরিস্থিতির কথা! কিন্তু যখন এ সম্পর্কে এসে পড়ে
কিছু ভিন্ন ধরনের প্রসঙ্গ, তখন তা জন্ম দেয় আরো বিতর্কের। বিশেষ করে আমাদের
দেশের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু বিষয় সামাজিক বিতর্কের সৃষ্টি করে, প্রশ্ন ওঠে
ভালো-মন্দ দিক নিয়ে। কিন্তু আদতে কি এসব বিষয় প্রেমের সম্পর্কে কোনো
হেরফেরের সৃষ্টি করে? নাকি অযথাই সমাজ এসব নিয়ে মাথা ঘামায়? রয়েছে কি এ
প্রসঙ্গগুলোর ভালো-মন্দ দিক? জেনে নিন এমন কিছু ব্যাপার সম্পর্কে যেগুলো
প্রেমের ক্ষেত্রে জন্ম দেয় বিতর্কের।
শারীরিক সম্পর্ক :
প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গেলে
প্রথমেই চলে আসে শারীরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ। পৃথিবীর সকল ধর্মেই বিয়ের আগে
শারীরিক সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ককে আখ্যা
দেয়া হয়েছে পাপ হিসেবে, এর জন্য রয়েছে বিশেষ শাস্তি। কিন্তু বর্তমান সময়ে
অনেকেই বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ককে পাপ বলতে নারাজ! কারণ, অনেকের কাছেই এ
ব্যাপারটি সম্পর্ককে মজবুত করার মাধ্যম মাত্র।
অথচ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রেমের
সময়ের শারীরিক সম্পর্ক দাম্পত্যজীবনে ডেকে আনতে পারে মুসিবত। এছাড়া বিয়ের
আগে শারীরিক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, অকাল
গর্ভপাতের মতো বড় বড় সমস্যা। মোটকথা, সমাজ বা ধর্ম কোনোভাবেই স্বীকৃতি দেয়
না প্রেমের সময়ে শারীরিক সম্পর্ককে। কিন্তু প্রেমের আবেগের স্রোতে ভেসে
গিয়ে প্রেমিকযুগল সবকিছু ভুলে গিয়ে লিপ্ত হন শারীরিক সম্পর্কে। পাশ্চাত্য
দেশসমূহে এটি কোনো ব্যাপার না হলেও আমাদের দেশে এটি একটি বিতর্কিত বিষয়।
যেহেতু প্রেমের ক্ষেত্রে যুক্তিতর্ক একটু কম কাজ করে, তাই এ বিষয়টি
সম্পর্কে একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। বিতর্কের পক্ষে বিপক্ষে মতামতও
তাই হরেক রকম।
ধর্মীয় পার্থক্য :
আমাদের সমাজে ধর্মীয় পার্থক্য প্রেমের
ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে দুই ধর্মের দুজন মানুষ
সহজেই প্রেমে বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারলেও আমাদের তা দুরূহ ব্যাপার।
যদিও এ ধরনের বিয়ের জন্য রয়েছে বিশেষ আইন, তবুও সামাজিক কারণে এ ধরনের
সম্পর্ক থেকে অনেকেই পিছিয়ে আসেন। বলা হয়ে থাকে, মানব ধর্ম সবচেয়ে বড় ধর্ম!
তাই যদি হয়, তাহলে দুটি মানুষের মিলনে ধর্মীয় পার্থক্য কোনো বাধা হতে পারে
না। অথচ অন্য ধর্মের কাউকে ভালো লেগে গেলেও ছেলেটি বা মেয়েটি নিজের
ভালোবাসাকে গলা টিপে হত্যা করে শুধুমাত্র এই কারণে যে, তার পছন্দের মানুষটি
অন্য ধর্মের। ধর্মীয় বাধাকে আমাদের সমাজে অনেক বড় করে দেখা হয়। তাই অনেক
প্রেমিকযুগল ধর্মকে বাধা না মানলেও তাদের কপালে জোটে সামাজিক লাঞ্ছনা ও
গঞ্জনা। এমনকি বিয়ের আগে তো বটেই, পরেও পড়তে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
লিভিং টুগেদার :
পাশ্চাত্যে লিভিং টুগেদার খুব সাধারণ একটি
বিষয় হলেও আমাদের দেশে তা ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরেও
অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের সমাজে লিভিং টুগেদার করার প্রবণতা দিন দিন
বেড়েই চলেছে। সামাজিকভাবে স্বীকৃত না হলেও গোপনে গোপনে অনেক প্রেমিকযুগলই
লিভিং টুগেদার করে থাকে। একই ছাদের নিচে তারা বসবাস করে স্বামী-স্ত্রীর মতো
বসবাস করে বিয়ে না করেই। অনেকেই স্বামী-স্ত্রীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বাসা
ভাড়া করে থাকে। যারা একা থাকে বা পরিবার থেকে দূরে থাকে, তাদের মধ্যেই এই
প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই লিভিং
টুগেদারও একটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ। এতে কি পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সহজেই শেষ
হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না? যেহেতু এটা সমাজস্বীকৃত বিষয় নয়, তাই এতে
সম্পর্কের দায়টাও থাকে না। ফলে এসব প্রেমের সম্পর্ক হয় ভঙ্গুর। প্রেমের
সম্পর্কের যে মাধুর্য থাকে, তা এখানে থাকে অনুপস্থিত। তাই স্থায়ী সম্পর্ক
অর্থাত্ বিয়ে ছাড়া লিভিং টুগেদারের এই সম্পর্ক মোটেও ভালো ফলাফল বয়ে আনে
না।
প্রেমিকা বয়সে বড় হওয়া :
ইসলাম ধর্মে মহানবী (স) কে সকল বিষয়ে
আদর্শ হিসেবে মানা হয়। তিনি বিয়ে করেছিলেন তাঁর চেয়েও বয়সে অনেক বড় এক
নারীকে। অথচ আমাদের সমাজে যদি কেউ তার চেয়ে বয়সে বড় কোনো নারীকে বিয়ে করে,
তাহলে তাকে হেয় করা হয়, তাকে হতে হয় নানা রকম বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন।
কেন এই মানসিকতার বৈপরীত্য? শুধু বিয়ে নয়, প্রেমের ক্ষেত্রেও রয়েছে সামাজিক
বাধা। মনের সম্পর্কে বয়সটা কোনো মুখ্য বিষয় হওয়া আদতেই উচিত নয়। একজন মেয়ে
যদি তার চেয়ে বয়সে বড় ছেলেকে বিয়ে করতে পারে, তাহলে একটা ছেলে কেন তার
চেয়ে বয়সে বড় মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না? একই প্রশ্ন রয়ে যায় প্রেমের
সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। কী এক অদ্ভুত কারণে আমাদের সমাজ এই অসম বয়সের প্রেমকে
কোনোভাবেই মেনে নিতে চায় না! বিশেষ করে প্রেমিকা যদি প্রেমিকের চেয়ে বয়সে
বড় হয়, তাহলে তা জন্ম দেয় হাজারো প্রশ্নের, হয়ে ওঠে বিতর্কিত একটি প্রসঙ্গ।
সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য :
সামাজিক অবস্থান এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়
যা শুধু প্রেম নয়, বিয়ের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। প্রত্যেকটা মানুষই তার সম
অবস্থান বা তার চেয়ে উঁচু অবস্থানের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে চায়। বিশেষ
করে মেয়েরা এ ব্যাপারে একটু বেশিই হিসেব কষে। এর অন্যতম কারণ হলো সামাজিক ও
আর্থিক নিরাপত্তা। এ দু ধরনের নিরাপত্তার খাতিরেই মেয়েরা তার চেয়ে নিচু
অবস্থানের ছেলেদের সাথে সম্পর্ক করতে চায় না। এমনকি জাত বা কাস্টের
ব্যাপারটিও প্রেমের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। অনেকেই
অসম সামাজিক অবস্থানে থেকেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। তবে এসব ক্ষেত্রে
তাদের হতে হয় অসংখ্য বাধার সম্মুখীন। পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব,
সমাজ – সবাই বাধা প্রদান করে থাকে।
শারীরিক সৌন্দর্য :
যে যাকে যত বেশি ভালোবাসে, তার চোখে সে তত
বেশি সুন্দর – এই চরম সত্য কথাটি কেন যেন আমাদের সমাজ মেনে নিতে চায় না!
আমাদের সমাজে শারীরিক সৌন্দর্যকে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। ঠিক
এ কারণেই যখন কোনো ফর্সা, রূপবান ছেলে তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সুন্দর ও
কালো মেয়ের প্রেমে পড়ে, তখন তার দিকে সবাই তীর্যক চোখে তাকায়। একই ব্যাপার
ঘটে সুন্দরী মেয়েদের ক্ষেত্রেও। অসুন্দর বা কম সুন্দর নারী-পুরুষদের যেন
প্রেম করার যোগ্যতা নেই! তাই শারীরিক সৌন্দর্যও আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে
প্রেমের ক্ষেত্রে একটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ।
ডিভোর্সের পরে প্রেম :
একবার বিয়ে করলে এবং সেই বিয়ে ভেঙে গেলে
কি মানুষটি প্রেম করার অধিকার হারিয়ে ফেলে? কোনো ডিভোর্সড নারী বা পুরুষ
প্রেমে পড়লে আমাদের সমাজ যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাতে তো তাই মনে হয়! এমনকি
তাদের এ কথাও শুনতে হয় যে, এই প্রেম হয়তো বিয়ের আগে থেকেই ছিল বা এই
প্রেমের কারণেই হয়তো বিয়ে ভেঙে গেছে। অথচ নিজের মনের কথা শোনার অধিকার
সবারই আছে। তালাকের পরে আবার বিয়ে আমাদের সমাজে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া
হলেও প্রেমের ব্যাপারটা বাঁকা দৃষ্টিতে দেখা হয়।
No comments:
Post a Comment